ফিতরার নিয়ম ও গুরুত্ব

প্রকাশঃ জুন ২০, ২০১৬ সময়ঃ ৩:৩২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৩:৩২ অপরাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ

123537Fitra

ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ বা অন্য কোনো পরিমাণ সম্পদের মালিকদের পক্ষ থেকে গরিবদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের একটি অর্থ প্রদান করার বিশেষ আয়োজনকে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক সাদকাতুল ফিতর বলা হয়। ইসলামী শরিয়তের হুকুম মোতাবেক এটি একটি ওয়াজিব আমল।

ফিতরার পরিমাণ আসলে কত?

নবীজি (সা.)-এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। যথা- খেজুর, কিশমিশ, জব ও পনির। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমাদের সময় ঈদের দিন এক সা খাদ্য দ্বারা সাদকা আদায় করতাম। আর তখন আমাদের খাদ্য ছিল জব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। [সহিহ বোখারি] রাসুল (সা.)-এর যুগে গমের ভালো ফলন ছিল না বিধায় আলোচিত চারটি পণ্য দ্বারাই ফিতরা আদায় করা হতো।

এরপর হজরত মুয়াবিয়ার (রা.) যুগে গমের ফলন বেড়ে যাওয়ায় গমকে আলোচিত চারটি পণ্যের সঙ্গে সংযোজন করা হয়। আর তখন গমের দাম ছিল বাকি চারটি পণ্যের তুলনায় বেশি। আর মূলত এই দাম বেশি থাকার কারণেই হজরত মুয়াবিয়া গমকে ফিতরার পণ্যের তালিকভুক্ত করেছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলেন, নবীজি (সা.) এক সা খেজুর বা এক সা জব দিয়ে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। পরবর্তী সময় লোকজন (সাহাবা আজমাইনরা) দুই মুদ গমকে (আধা সা) এগুলোর সমতুল্য মনে করে এবং আদায় করে। [বোখারি]

ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, গম দ্বারা আদায় করলে আধা সা বা এক কেজি ৬২৮ গ্রাম দিলেই ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। আর বাকি চারটি পণ্য অর্থাৎ খেজুর, জব, পনির ও কিশমিশ দ্বারা আদায় করার ক্ষেত্রে জনপ্রতি এক সা বা তিন কেজি ২৫৬ গ্রাম দিতে হবে। দেখা যাচ্ছে যে গম ছাড়া অন্য পণ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করলে এক সা পরিমাণ দিতে হচ্ছে, যা গমের ওজনের দ্বিগুণ এবং মূল্যের দিক দিয়েও অনেক তফাত। হাদিসে এক সা আদায় করার কথা উল্লেখ থাকার পরও তখন এর মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় সাহাবারা আধা সা পরিমাণ গম আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন আধা সা গমের মূল্যও অন্য চারটি পণ্যের এক সা-এর চেয়েও বেশি ছিল।

বর্তমানে সব মুসলিম দেশেই ফিতরার পরিমাণ রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারণ করে হয়ে থাকে। এটা অবশ্য ইসলামের নীতিমালার আলোকেই হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রতি বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন ইসলামিক সেন্টার মাথাপিছু একটি পরিমাণ ঘোষণা প্রদান করে এবং সে ঘোষণা অনুযায়ী সবাই ফিতরা প্রদান করে। ফিতরার নিয়মটি হলো, গম, আটা, পনির, কিশমিশ, খেজুর ও যব পণ্যের যে কোন একটির দ্বারা ফিতরা দেওয়া যাবে। গম বা আটা দ্বারা ফিতরা নির্ধারণ করলে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর সমমূল্যের টাকা আদায় করতে হবে। ব দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২০০ টাকা, কিশমিশ দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১ হাজার টাকা, খেজুর দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং পনির দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১৬৫০ টাকা ফিতরা আদায় করতে হবে। মুসলমানরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী এসব পণ্যের যে কোনো একটি পণ্য বা তার বাজার মূল্য দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবেন। উল্লেখ্য, এসব পণ্যের স্থানীয় খুচরা বাজার মূল্যের তারতম্য রয়েছে। সে অনুসারে স্থানীয় মূল্যে পরিশোধ করলেও ফিতরা আদায় হবে।

ফিতরা কারা দেবেন ও কাদের দেবেন

হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, রাসুল (সঃ) মুসলিম ক্রীতদাস, স্বাধীন পুরুষ ও নারী, ছোট-বড় সবার উপর রমজানের সদকাতুল ফিতর এক সা খেজুর অথবা যব ওয়াজীব করেছেন (মুসলিম)।

রাসুল (সঃ) বলেন, তোমরা এক সা গম আদায় কর প্রত্যেক ব্যক্তির তরফ থেকে। সে পুরুষ হোক বা নারী। কিংবা ছোট হোক বা বড়, স্বাধীন হোক বা ক্রীতদাস। ধনী হলে আল্লাহপাক তাদের পাক-পবিত্র করবেন এবং ফকির হলে আল্লাহ তাদের তার চেয়ে অধিক বিনিময় দিবেন। যতটা তারা দিবে (বায়হাকী)।

হাদীস দুটি প্রমাণ করে ফিতরা কাদের ওপর ওয়াজিব। নারীদের উপরও ফিতরা ওয়াজিব। তার স্বামী থাকুক বা না থাকুক। স্বামী থাকলে স্বামীর ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। অবিবাহিত মেয়েদের ফিতরা তার পিতা বা অভিভাবককে দিতে হবে। অভিভাবক না থাকলে নিজেই নিজের ফিতরা দিতে হবে। ছোটদের উপরও ফিতরা ওয়াজিব। নাবালকদের ফিতরা তার পিতার উপর ওয়াজিব।

ইমামে আযম ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর মতে সাহেবে নিসাব অর্থ্যাৎ সঙ্গতিসম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের পক্ষ হতে এবং তার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের উপর থেকে ফিতরা আদায় করবে। সাহেবে নিসাব বা সঙ্গতি সম্পন্ন হলো সেই ব্যক্তি যার নিকট সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা থাকে। যাকাতের বেলায় সারা বছর এই মাল বা সমপরিমাণ মাল তার হাতে থাকা শর্ত কিন্তু ফিতরার বেলায় সারা বছর নয়। বরং ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের সময় এই পরিমাণ মাল বা অর্থ তার অধীনে থাকলেই তাকে ফিতরা দিতে হবে।
কোন ব্যক্তি যদি সিয়াম নাও করেন তবুও তাকে ফিতরা দিতে হবে।

অমুসলিমরা সিয়াম করেনা। কিন্তু হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) তাঁর অমুসলিম ক্রীতদাসের জন্য ফিতরা আদায় করতেন। যে রোজা রাখেনি তার ফিতরা দেওয়ার মধ্যে দুটি লাভ – (১) সে মিসকিনদের খাবারের ব্যবসা করে যা ফিতরার একটি উদ্দেশ্য (২) সিয়াম পালন না করে সে যে অপরাধ করেছে, তার জন্যে সে তার প্রভূর যে ক্রোধের পাত্র হয়েছে তা থেকে হয়ত সে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতেও পারে। যেমন রাসুল (সঃ) বলেন, নিশ্চয়ই দান সদকা প্রতিপালকের ক্রোধ মিটিয়ে দেয় (তিরমিযী)।

ফিতরার আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব

“সাদকাতুল ফিতর সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, তোমরা এ দিনটিতে তাদেরকে অন্যের কাছে চাওয়া থেকে বিরত রাখো। জাকাতের মতো এটিও দরিদ্র মানুষের ওপর মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আমলি সহযোগিতা।”

ফিতরা আদায় করা মহান আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ একটি আদেশ। গরিব-অসহায় মানুষদের হক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এই সাদকাতুল ফিতরাকে। পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ মহান ঈদের আনন্দ প্রদান করেছেন। সমাজে বসবাসকারী ধনিক শ্রেণীর মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে গরিবরাও যাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, এজন্য এই সাদকাতুল ফিতরের আমলকে সঙ্গতিসম্পন্ন সকল মুসলমান নারী-পুরুষের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে। ফিতরার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে বসবাসকারী ধনীদের অর্থ গরিবদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং এ দ্বারা গরিবদের জীবন-যাপনে কিছুটা হলেও গতি ফিরে আসে। এ জন্য ইসলামে সাদকাতুল ফিতরের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ফিতরা দানের মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী জনসাধারণের মধ্যে সমতার সৃষ্টি হয়, সামাজিক বৈষম্যের কিছুটা হলেও লাঘব হয় এবং সমাজের সচ্ছ্বল ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়।

পবিত্র রমজান মাসে রোজাদারের সর্বশেষ কর্তব্য হলো ফিতরা প্রদাণ। ফিতরা প্রদাণের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় এবং রমজান মাসে রাখা রোজায় যদি কোন ভুল-ত্রুটি থাকে তাকে ফিতরা ত্রুটিমুক্ত করে। ফিতরার বিধান হচ্ছে ঈদ-উল-ফিতরের সালাতের পূর্বেই তা আদায় করা।

ফিতরার গুরত্ব বিবেচনা করে আসুন আমরা নিয়মমতো ফিতরা আদায় করি এবং একটি বৈষম্যমুক্ত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সচেষ্ট হই।

 

 

প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G